Breaking

Thursday, October 4, 2018

একটি আত্মহত্যার ইতিবৃত্তঃ- লিখেছেন -আহমিদা জেবিন


ঘটনার শুরু গত শুক্রবার সকালে। আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলাম ক্লাশের এক ফ্রেন্ডের সাথে। কথা প্রসঙ্গে সে একসময় জানালো এই মাসের প্রতিদিন ই আমাদের ক্লাশ টেষ্ট দিতে হবে।
এটা শুনে এপাশ থেকে আমি বললাম, 'ধুর, এইভাবে কি বেঁচে থাকা যায়, বল?

সেও একমত হলো আমার সাথে। আরো কিছুক্ষণ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে বলতে একসময় বললো, 'ভার্সিটির সিনিয়র আপু মার্জিয়া নাকি তৃতীয় বিয়ে করতেছেন'।
হায়রে কপাল! কেউ একটার পর একটা বিয়ে করতেই থাকে আর আমাদের ভাগ্যে?? আমি মজা করেই বললাম, 'এই জীবন আর রেখে কি লাভ! বিদায় পিতিবি!!'
.
তারপর আরো দুই একটা কথা শেষে আল্লাহ হাফেজ বলে ফোন রেখে দিলাম। আমি তখনো ঘূণাক্ষরেও টের পাইনি যে আমাদের বাসার মুখরা কাজের বুয়া শরীফার মা ব্যালকনির পাশের ঘর ঝাড়ু দিতে দিতে আমার বলা যাবতীয় কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। আমি তখনো টের পাইনি একটু পরেই আমার জীবনে কি মহা দূর্যোগ নেমে আসতে যাচ্ছে।
.

আমি ফোন রেখে দিয়ে বেডরুমে গেলাম। ভাবলাম আজ ছুটির দিন বাসায় বসে না থেকে একটু ঘরটা পরিস্কার করে ফেলি। পাশের রুমে উকি দিয়ে দেখি আম্মু ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে আমি ঘর পরিস্কার করেছি দেখলে অনেক অবাক হবে। খুশিও হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। একটা পুরাতন উড়না নিয়ে বিছানার উপর উঠে সিলিং ফ্যান পরিস্কার করার জন্য হাত লাগালাম। ফ্যানে প্রচুর ধুলা জমেছে। যেই গরম পরছে, ফ্যানটা পরিস্কার করার এখনই সময়। আমি কাজ শুরু করলাম।
.
পেছনে বিকট চিৎকার শুনে আরেকটু হলেই আমি খাট থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যাওয়ার যোগাড়। চিৎকার দিচ্ছে আর কেউ না, আমাদের বুয়া শরীফার মা।
গায়ের সমস্ত শক্তি এক করে প্রচন্ড চিৎকার দিচ্ছে, 'হায় আল্লাহ, আফা তো নিজেরে খতম কইরা দিতে চাচ্ছে। ও আম্মা এদিকে আসেন। আপনি কই। এই কে কুথায় আছেন আমার আফারে বাঁচান। আপনারা কই? আপনাদের আল্লাহর দোহাই লাগে আপনারা সবাই আসেন।'
.
আমি ঠিকমতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম আশেপাশের বাসার সমস্ত লোক আমার ঘরে। দৌড়ে আসার জন্য হাফাচ্ছেন অনেকেই। কয়েকজন বলশালী পুরুষের হাতে কাঠ এবং বাশের লাঠি। একজনের হাতে রড। আমি খাটের উপর দাঁড়ানো। আমার হাত ফ্যানের সাথে। আমার হাতে রশির সমান লম্বা একটা উড়না।
তারা যা বুঝার বুঝে ফেললো। একজন দৌড়ে এসে আমার হাত থেকে উড়না কেড়ে নিলো। সাথে আরো দুইজন খাটের উপর উঠে আমাকে চ্যাংদোলা করে মোটামুটি খাট থেকে ছুঁড়ে ফেললো। আমি কি করেছি এখনো সেটা বুঝতে পারছি না। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার মাথা কাজ করছে না।
.
আমার আম্মু এমনিতে ছিঁচ কাঁদুনে মহিলা। তিনি ইতিমধ্যে তার কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
'আল্লারে, এ আমার কি হলো! আমার এত আদরের মেয়ে, আল্লাহ তারে তুমি নিয়ে যাইয়ো না। আমার কোল খালি করে দিও না গো আল্লাহ।'
.
আমি যে কিছু বলবো সেই সুযোগ পাচ্ছি না।
.

চশমা পরা এক লোক যাকে আমি এর আগে কখনো দেখিনাই বলে মনে হচ্ছে, সে আমার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো, 'তুমি জানো সুইসাইড করে ভীতু রা? তুমি ভীতু? একটা ছেলে তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে বলে তুমি নিজেকে শেষ করে দিতে চাচ্ছ? একবারও তোমার মায়ের কথা ভাবলে না? দেখ একটু তোমার মায়ের দিকে তাকিয়ে, কেমন কান্না করতেছে। আর কোথাকার কোন ছেলে তোমার কাছে বড় হয়ে গেল। ইউ নো তোমাদের এই জেনারেশনেরই প্রবলেম এটা। তোমরা একটা লুজার জেনারেশন। প্রেম ভালোবাসা ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝো না লাইফে।'
.
আশ্চর্য! এই লোক আবার প্রেম, ছ্যাকা, ছেলে এইসব কই পাইলো? কি সর্বনাশ!
.
ব্যাপারটা আসলেই সর্বনাশ, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই ছড়িয়ে গেলো আমি কোনো একজন ছেলের জন্য সুইসাইড করতে যাচ্ছিলাম।
.
আমার আম্মু কান্নার গতি বাড়ালেন।
'হায়রে এ আমি কি শুনলাম। হায় আল্লাহ এটা শোনার আগে তুমি আমারে উঠায় নিলে না কেন। বল তুই কোন সে রাক্ষস। কে আমার কোল থেকে আজ আমার মেয়ে রে ছিনিয়ে নিতে চাইতেছে। আমি এ মুখ কই দেখাবো। এ আমি কি শুনলাম।'
.
আমি দুই একবার বলার চেষ্টা করলাম যে তুমরা যা ভাবছো ব্যাপারটা আসলে তা নয়। কিন্তু কেউ আমার কথা পাত্তা দিলো না। সবাই মনোযোগ অন্য দিকে। তারা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আমাদের কাজের বুয়ার কথা শোনায় ব্যাস্ত।
.

শরীফার মা সিরিয়াস ভঙ্গিতে সবার সামনে বক্তব্য রাখতেছে-
'আর কইয়েন না, একটু আগের কাহিনী। ভাবলে এহনো আমার শইল্লের লোম খাড়া হয়ে যাইতেছে। দেহেন আপনেরা, পরীক্ষা কইরা দেহেন। আমি তো ঘর ঝাড় দিতেছি, এমন সময় দেহি আফায় ফোন নিয়ে আস্তে করে বারান্দায় চলে গেলো। আমি তহনই বুঝছি কোনো পোলার ফোন। আমি আছি ধান্দায়। কি কয় শুনি। একটু পরে শুনি আফায় হাউমাউ করে কাঁনতেছে। কানতে কানতে একবার কইলো এইভাবে বাঁইচা থাকন যায় না, আরেকবার কইলো এই জীবন রাইখা কি লাভ! মাঝে একবার বিয়ের কথাও কইলো। বুঝলাম আফার প্রেমিক আফারে বিয়া করবো না কইছে।
পরে ফোন রাইখা চোখ মুছতে মুছতে বারান্দা থেইকা বের হইলো। সোজা এদিক ওদিক তাকায়ে নিজের ঘরে ঢুকলো চোরের মতো। বুঝলাম ঘটনা তো সন্দেহজনক। আম্মা আরেক ঘরে ঘুমাইতেছে। আমি ছাড়া এই বাড়িতে আফা রে বাঁচানোর মতন কেউ নাই। দেহি আফায় রশি খুঁজতেছে। রশি না পাইয়া একখান পুরান উড়না বের করলো। সেইটা নিয়ে উঠছে খাটের উপরে। ফ্যানের সাথে ফাঁস বান্ধা শুরু করছে। আমি কি করবো আমার মাথা কাজ করেনা। গাও হাত পা থরথর কইরা কাপে। তারপর আল্লাহর নাম নিয়া দিলাম চিক্কুর। সবার আগে হইলো জানের দাম। আপনারা না আসলে আইজ আফার জান বাঁচানো যাইতো না।'
.
আমি দেখলাম কয়েকজন মুরব্বী শরীফার মায়ের উপস্থিত বুদ্ধির ব্যাপক প্রশংসা শুরু করলো। আজকাল যে এতো বুদ্ধিমান কাজের বুয়া আছে এটা নাকি তারা জানতো না।
শরীফার মা একগাল হেসে একই গল্প শুরু করলো আবার। দর্শনার্থী বাড়তেছে। নতুন যারা আসছে তারাও ঘটনা শুনতে চায়।
দ্বিতীয় বারের বলা গল্পে বের হলো আমি নাকি শরীফার মাকে বলছি, আমি না থাকলে তুমি আমার আম্মুর খেয়াল রাইখো।
পঞ্চম বার বলার সময় গল্পে যোগ হলো আমি চিৎকার করে বলেছি, 'হে আল্লাহ তুমি আমাকে উঠায় নাও। আমি তাকে ছাড়া বাচবো না। হে পৃথিবী বিদায়!'
.
বাস্তবিকই আমার কিছু বলার ছিলো না। আমি শুধু শুনে গেলাম। রাত পর্যন্ত বাসায় লোক আসতে লাগলো। দূর দূরান্ত থেকে নাম জানা আত্মীয়রাও একবার করে আমাকে এবং এই জেনারেশনের প্রেম ভালোবাসাকে তিরস্কার করে গেলো। তারপর ফিরে যাওয়ার সময় আম্মুকে বার বার সাবধান করে গেলো যে আমাকে যেন চোখে চোখে রাখা হয়।
.
বাসা ফাঁকা হতে হতে গভীর রাত হয়ে গেলো।
আমাকে রাতে আম্মুর রুমে ঘুমাইতে হলো এবং আম্মু সারা রাত না ঘুমিয়ে জেগে রইলেন।
.
আস্তে আস্তে আমার জীবন বিভীষিকায় পরিণত হলো। আমাকে ক্লাশে যাইতে দেয়া হলো না। রুমে কখনোই একা থাকতে দেয়া হলো না, এবং বাথরুমে গেলেও দরজা লক করার অনুমতি পেলাম না। আম্মু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, 'আমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছি তুই ফ্রেশ হ। মায়ের কাছে মেয়ের আবার লজ্জা কি!!
এতেই শেষ না, প্রতি দুই মিনিট যেতে না যেতেই আম্মু আওয়াজ দিলেন, কি রে কথা বল। ঠিক আছিস? হচ্ছে ঠিকমতো?'
.
আমাকে কথা বলে জানিয়ে দিতে হলো আমি ঠিক আছি। হারপিক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছি না।
.
আমি আম্মুকে অনেক বুঝিয়ে সপ্তাহখানেক পর অল্প সময়ের জন্য বাইরে বের হওয়ার অনুমতি পেলাম। বের হয়ে দেখি আমার গুনধর কাজিন শয়ন অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে আমাকে সাবধানে ফলো করছে। বুঝলাম আম্মুর নির্দেশ। এলাকার প্রতিটা মুরব্বী আমাকে রাস্তার মাঝে দাঁড় করিয়ে একেকজন পনেরো মিনিট করে, 'আমার কেন সুইসাইড করা উচিত না' সে বিষয়ে বিস্তর জ্ঞান দান করতে লাগলেন।

আমি তাদের থেকে বাঁচতেই একটা মুদিখানার দোকানে ঢুকলাম।
আমার বাসায় তেলাপোকার প্রচুর দৌরাত্ম্য, এবং বাথরুমের হারপিক শেষ হয়ে যাওয়া স্বত্তেও আমার সাহস হলোনা দোকানে গিয়ে তেলাপোকা মারার বিষ বা হারপিকের কথা বলার। আমি জানতে চাইলাম, মশা মারার এরোসল হবে?
দোকানদার সরু চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, ' মা'রে এরোসল খাইলে তো তুমি মরবা না। অসুস্থ হয়ে পরবা শুধু। তাছাড়া তুমি এরোসল খেয়ে মরতে চাও ই বা কেন? এই বয়সে কি এমন কষ্ট তোমার? নিজেকে একটু সময় দাও, ঠিকই ছেলে টারে ভুলতে পারবা। তখন সুইসাইড করতে চাওয়ার জন্য তোমার নিজেরই আফসোস হবে।'
.
এই সমাজে সারভাইভ করা আমার পক্ষে সম্ভব না আর। আমি বাসায় ফিরে এসেছি। রাতের খাবার খাচ্ছি। শুনলাম পাশের রুমে শয়ন ফিসফিস কইরা আম্মু রে বলতেছে, 'ছোট আপু দোকানে যাইয়া কয় বিষ দ্যান। যে বিষ খাইলে দশ মিনিটেই খেল খতম। দোকানদার দেয় নাই বিষ। ছোটো আপু রে অনেক বুঝাইয়া বাসায় ফিরত পাঠাইছে।'
.
আম্মু কিছু না বলে ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না শুরু করলো। আমি এপাশের ঘরে ভাত খেতে খেতে ফাইনাল ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। আমি সুইসাইড ই করবো। এইভাবে আর বেঁচে থাকা সম্ভব না। শুনলাম আম্মু শয়ন রে বলতেছে, ওর ঘর থেকে ফ্যান খুলে ফেলো। মরে যাওয়া থেকে গরমে একটু কষ্ট পাওয়াও ভালো।'
.
হ্যা আমাকে সুইসাইড করতেই হবে। বাঁচতে চাইলে মরতে হবে আমার। এইভাবে কারো পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব না। কোনোভাবেই সম্ভব না........


আত্নহত্যা....
আহমিদা জেবিন

আপনার মন্তব্য আশা করছি
আপনাদের কমন্টেই আমাদের নতুন নতুন লেখায় উৎসাহ যোগায়
এমন আরো পোস্ট পেতে আমাদের ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করুন
Join

No comments:

Post a Comment

close